সুনামগজ্ঞ জেলা কারাগার – অনিয়ম চাদাবাজী ও নির্যাতনের অভয়ারন্য

প্রকাশিত: 2:55 PM, July 24, 2018

অনলাইন ডেক্স: সুনামগঞ্জ জেলা কারাগারের ভেতরে কারা সিন্ডিকেটের নতুন ধরনের নিপীড়ন ভোগ করছে ভেতরে অবস্থানরত অনেক বন্দী। কারাগারের ভেতর সিট (ঘুমানোর জন্য ২০ ইঞ্চি জায়গা) না কিনলে সবাইকে কারাগার কর্তৃপক্ষের টাকা আদায়কারী কয়েদিদের দ্বারা নির্যাতন সইতে হয়। টাকা দিলেই মিলে সিট ও ভাল আচরণ। এছাড়া কারাগারের ভেতরে বন্দীদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। বিছানার নিচে মাদক দিয়ে হয়রানির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হয়।
যারা টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন তাদের কপালে জোটে নির্যাতন। আদায়কৃত টাকা ভাগাভাগি করে নেয়া হয়। আদায়কৃত টাকার মোটা অংশের ভাগ পান জেল সুপার, জেলার, ডেপুটি জেলার, সুবেদার, সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি ও দু’একজন সাংবাদিক।
তবে জেলা সুপার আবুল কালাম আজাদ সকল অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে বলেছেন,‘সুনামগঞ্জ জেলা কারাগার খুব ভালভাবে চলছে। বন্দীর কাছ থেকে ক্যান্টিন ছাড়া অন্য কোনভাবে টাকা আদায় করার নিয়ম নেই। বন্দীদের নির্যাতন করার অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। কারণ একজন বন্দী আরেক বন্দীকে নির্যাতন করার সুযোগ নেই। সকল বন্দীই ভাল পরিবেশে আছেন। জেল ফেরত একাধিক অভিযোগকারী জানান, জেলে বসে বন্দীদের কাছে সিট বিক্রি করে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা আদায় করছে দিরাইয়ের কাউয়াজুরি গ্রামের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী নানু মিয়া ওরফে নানু দেওয়ান। তার কয়েদী নম্বর-৪৩৫৪/এ, সুনামগঞ্জ কারাগারে প্রবেশের তারিখ ২৭/১১/২০০৪ ইং, তার মুক্তির তারিখ-২৬/১১/২০৩৪ ইং। জেলবন্দী সকলকেই নানা কারণে টাকা গুণতে হয় বলে অভিযোগ করে এসব তথ্য জানিয়েছেন একাধিক জেল ফেরত লোক।
অভিযোগকারীরা জানান, জেলের ভেতরে যাওয়ার পরপরই সবাইকে সিট (কারাগারের মেঝেতে ঘুমানোর জায়গা) কিনতে হয়। কেউ ৩ হাজার, কেউ ৫ হাজার টাকা বা আরও বেশী টাকা দিয়ে সিট কেনেন। সিট বেচার মূল কাজ ও টাকা আদায় করেন কয়েদী নান্নু মিয়া। যারা সিট ক্রয় করতে পারেন না তাদের কপালে জোটে অমানুষিক নির্যাতন। যারা টাকা দিতে ব্যর্থ হন তাদের বাথরুমে ও সেলে আটকে রেখে মারধরও করা হয়। কোন বন্দী না জেনে কয়েদিদের এসব কাজের প্রতিবাদ করলেও তাদের কপালে জোটে নির্যাতন। ভেতরে বিচার বা নালিশ করার সুযোগ পান না কেউ। কারাগার পরিদর্শক ও কর্তৃপক্ষ কারাগার পরিদর্শনে গেলে বিচারপ্রার্থীদের ভয় দেখানো হয় অভিযোগ না করতে। কৌশলে তাদের দূরে রাখা হয়। কারা পরিদর্শন কার্যক্রমও দায়সারা গোছের হয়ে থাকে বলে জানা গেছে।
অভিযোগকারীরা জানান, কয়েদি নানু মিয়া তাদের জানিয়েছে কারাগারের ভেতরে আদায়কৃত টাকার ভাগ কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সুনামগঞ্জের দুইটি পত্রিকার সম্পাদকসহ কয়েকজন সাংবাদিককে দেয়া হয়। ৪-৫ হাজার টাকা করে সাংবাদিকদের মাসোহারা দেয়া হয়। পরিদর্শকদের প্রতি মাসে দেয়া হয় ১০ হাজার টাকা করে । যদিও এসব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলা কারাগারের পরিদর্শকরা।
সুনামগঞ্জ শহরের হাজিপাড়া বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ৩৭ এর বাসিন্দা ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন,‘সুনামগঞ্জ জেলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি খোলাখোলিভাবে হচ্ছে। জেল কর্তৃপক্ষের সবাই এসব বিষয় অবগত আছেন। আমি নিজেই তিন হাজার টাকায় সিট কিনেছিলাম। সিট বিক্রিসহ নানাভাবে প্রতিদিনই লাখ-দেড় লাখ টাকা আদায় হয়। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ভয়ে জেলের ভেতরে কেউ মুখ খোলতে চায় না। যারা প্রতিবাদ করেন তাদের কপালে নির্যাতন জোটে। সিট নিয়ে প্রতিবাদ করার কারণে ধর্মপাশার আল আমিন অরফে আরিফ বাঙালি নামের একজনকে নির্যাতন করে একমাস সেলে আটক রাখা হয়েছিল। ’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারাগার ফেরত দোয়ারাবাজার উপজেলার বাসিন্দা একজন ঠিকাদার বলেন,‘সারা দেশের কারাগারগুলোতে একজন বন্দীর জন্য ৩০ ইঞ্চি জায়গা বরাদ্দ থাকে। কিন্তু সুনামগঞ্জ জেলা কারাগারে একজনকে দেয়া হয় মাত্র ২০ ইঞ্চি। যারা জেল কর্তৃপক্ষের নিয়োগকৃত মেটকে (কয়েদি নেতাদের) চাহিদা মত টাকা দেয় তারাই এই সুযোগ পায়। যারা গরিব ও নিরীহ তাদের নির্যাতন সইতে হয়। মাত্র ৪ হাত জায়গার মধ্যে ৮/১০ জনকে রাখা হয়। একজন বন্দীকে মাত্র ১০-১২ ইঞ্চি জায়গা দেয়া হয়। ৪০ জন বন্দীর স্থলে ১০০ থেকে ১২০ জনকে পর্যন্ত রাখা হয় একটি ওয়ার্ডে। শুধুমাত্র বন্দীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য কারাগারের ভেতরে দুইটি ভবন চালু না করে ৮ টি ওয়ার্ডকে পরিত্যক্ত করে রাখা হয়েছে। এসবের নেতৃত্ব দেন দিরাইয়ের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি নানু দেওয়ান।’
অনেকেই জানান, জেলের ভেতরে থাকা লোকজনের কাছ থেকে অর্থ আদায় করার লক্ষ্যে একটি ওয়ার্ডে ৪০ জনের জায়গায় ৮০ জন থেকে ১০০ জনকে রাখা হয় গাদাগাদি করে। দুইটি ভবন ব্যবহার না করে পরিত্যক্ত করে রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীদের কাছ থেকে প্রতিদিন আদায় হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। গেইট দিয়ে দেখা করলে ৬০০ টাকা ও জানালা দিয়ে ২০০ টাকা করে নিয়ে স্বজনদের দেখার সুযোগ দেয়া হয়।
সুনামগঞ্জ জেলা কারাগারের দুর্নীতি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের পর সুনামগঞ্জ শহরের হাছননগরের বাসিন্দা শাহ ফরহাদ ফেইসবুক কমেন্টে লিখেছেন,‘শুধু মাদক নয় চাঁদাবাজীর অভয়ারণ্য এই কারাগার। জেলে ঢুকা মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে সিট কিনতে হয়। যেসব গরিব লোকজন টাকা দিয়ে সিট কিনতে পারেনা তাদের ফাইল নামক নরকপুরীতে থাকতে হয়। এক জনের উপর তিন জন ঘুমাতে হয়। কি যে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে গরিব অসহায় আসামীগণ তা না দেখলে বিশ্বাস করার মতন নয়। গোসল করতে গেলে টাকা দিতে হয়, তা না হলে ১৫ মিনিটে এক সাথে ৫০০ লোককে একটি ছোট্ট হাউসের পানি দিয়ে গোসল করতে হয়। যার ফলে জনপ্রতি একজগ পানি গোসলের জন্য পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়, অথচ ওয়ার্ড প্রতি আলাদা আলাদা সময় বেঁধে গোসল করতে দিলে পানির সমস্যা বিন্দু মাত্র হওয়ার কথা নয়। টাকা যারা দেয় তারা ঠিকই একা একা অফুরন্ত পানি দ্বারা গোসলের সুযোগ পায়। জেলের সবকিছুর মূল সর্দার কয়েদি নানু দেওয়ান। ’
সুনামগঞ্জ শহরের জামতলার বাসিন্দা সামারুল ইসলাম সাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,‘কয়েদী নানু দেওয়ান আমার কাছে নিজেই বলেছে প্রতিদিন তার মোটা অংকের টাকা রোজগার হয়। আদায়কৃত টাকা থেকে জেল কর্তৃপক্ষসহ সুনামগঞ্জের দুইজন সম্পাদককে প্রতি মাসে ৫ হাজার করে টাকা দেয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন,‘চাহিদামত টাকা না দিলে কারাগারের ভেতরে থাকা গরিব বন্দীরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। এমনকি টাকার জন্য মুচিদেরকে পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়। সদর উপজেলার টুকেরবাজার এলাকার ৫ জন মুচিকে মেরে তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার করে মোট ২৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ধর্মপাশার আরিফ বাঙালি নামের একটি ছেলেকে অনেকদিন সেলে আটকে রাখা হয়েছিল। নির্যাতনের ভয়ে সে এখন আর কোন কিছুরই প্রতিবাদ করে না।’
সুনামগঞ্জ শহরের পশ্চিম তেঘরিয়ার বাসিন্দা তৈয়বুর রহমান বলেন,‘ আমি ৬ মাস কারাগারের ভেতর ছিলাম। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর জামিনে মুক্ত হয়েছি। আমি স্বচক্ষে দেখেছি কারাগারের ভেতরে গাঁজা, ইয়াবা প্রকাশ্যে খায় কয়েদিরা। টাকার জন্য মানুষকে নির্যাতন করা হয়, কয়েক ইঞ্চি জায়গায় ঘুমাতে দেয়া হয়। সিটের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। সিট বিক্রির কাজ করে নানু দেওয়ান। পুরাতন জেলে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় পর্যন্ত সিট বিক্রি হত। নতুন জেল চালু হওয়ার পর সিটের টাকা কিছু করেছে। কেউ এসব কাজের প্রতিবাদ করতে চায় না। প্রতিবাদ করলে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। অনিয়মের প্রতিবাদ করায় শহরতলীর মাইজবাড়ির ইমরানকে জেলের ভেতরে দুইদফা নির্যাতন করা হয়েছে। প্রথমে জেলের কয়েদিরা মারধর করেছে, পরে কারারক্ষীরা তাকে গরুর মত মেরেছে। এছাড়া আরপিননগরের অয়ন গনিকে মারধর করেছে কারারক্ষীরা। জেল সুপার ও জেলারের নির্দেশকে উপেক্ষা করে করারক্ষীরা তাকে মারধর করেছিল। ’
সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. নজরুল ইসলাম সেফু বলেন,‘যারাই কারাগারে যান তাদের টাকা দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে হয়, এটা সবাই জানেন। যারা টাকা দেন তারাই ঘুমাতে পারেন, যারা টাকা দিতে পারেন না তারা ঘুমানোর সুযোগ পান না। টাকা না দিলে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। জেলা কারাগারের এই দুর্নীতি ও বন্দীদের নির্যাতনে বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।’
তথ্যসুত্র :দৈ:সু:খবর।

MYXJ_20180722222425_save

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই সংবাদটি 70 বার পঠিত হয়েছে

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ